সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণাটি প্রাচীন গ্রিক দর্শন, ভারতবর্ষ ও চীনের মৌলিক সামাজিক ও ধর্মীয় গ্রন্থে এবং খ্রিস্টানদের বাইবেলে একটি বিশেষ প্রত্যয় হিসেবে বিধৃত হয়েছে।
সামাজিক স্তরবিন্যাসের তত্ত্ব | Theories of Social Stratification
সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণাটি প্রাচীন গ্রিক দর্শন, ভারতবর্ষ ও চীনের মৌলিক সামাজিক ও ধর্মীয় গ্রন্থে এবং খ্রিস্টানদের বাইবেলে একটি বিশেষ প্রত্যয় হিসেবে বিধৃত হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিজ্ঞানসম্মত একটি সাধারণ মতবাদ প্রতিষ্ঠার দুটি প্রধান প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। একটি ক্রিয়াবাদীদের কর্তৃক অনুসৃত অপরটি মার্কস প্রবর্তিত।”
অর্থাৎ ক্রিয়াবাদী মতবাদ (Functional theory) এবং দ্বান্দ্বিক মতবাদ (Conflict theory)। স্পেন্সার সর্বপ্রথম ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব (Functional approach) কথাটি ব্যবহার করেন।
পরবর্তীকালে এমিল ডুর্খেইম (Dhurkheim). ম্যালিনোস্কি (Malinowski) এবং র্যাডক্লিফ ব্রাউন (Radcliffe Brown) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানী সমাজ ও সংস্কৃতি পাঠে ক্রিয়াবাদের সাহায্য নেন এবং ব্যাপক আলোচনা করেন।
ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে ডেভিস ও মুর (Davis and Moor) এবং ট্যালকট পারসন্স (Talcott Parsons) অন্যতম। অপরপক্ষে, দ্বান্দ্বিক মতবাদীদের মধ্যে কার্ল মার্কসের নাম উল্লেখযোগ্য।
দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব | Conflict Theory
দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্ব সমাজের স্তরবিন্যাস বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ তত্ত্ব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্কের সাথে যুক্ত।
যেসব সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক স্তরবিন্যাসের দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব প্রদান করেন তাদের মধ্যে মার্কস, ডারেনডর্ফ, রেন্ডাল রবসন অন্যতম। এ তত্ত্বে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা ও অ-মালিকানার ভিত্তিতে সামাজিক শ্রেণিসমূহকে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
এভাবে ইতিহাসের প্রত্যেক শ্রেণিসমাজে পরস্পর বিরোধী দুটি প্রধান শ্রেণির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়।
মার্কসের তত্ত্ব | Marx's Theory
মার্কস বলেন, ইতিহাসে সামাজিক সংগঠন এবং সামাজিক পরিবর্তন ও ব্যক্তিগত আচরণের মূল চাবিকাঠি হলো শ্রেণি।
সমাজে এ শ্রেণি সৃষ্টি হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে। তিনি বলেন, সমাজ দুইটি বিপরীত শ্রেণিতে বিভক্ত।
একটি শ্রেণি গঠিত হয় তাদের দ্বারা যারা উৎপাদনের সাথে জড়িত নয় অর্থাৎ শোষক শ্রেণি। আবার অপরটি হলো উৎপাদন সম্পর্কের সাথে যারা জড়িত অর্থাৎ শোষিত শ্রেণি।
এ সমাজের মূল কথা হলো অর্থনৈতিক সম্পদ (Economic resource) কে কেন্দ্র করে সমাজে শ্রেণির সৃষ্টি হয়। মার্কস তার বিখ্যাত The Communist Menifesto গ্রন্থে সমাজকাঠামোকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন।
- ক. মৌল কাঠামো (Basic Structure)
- খ. উপরি কাঠামো (Super Structure)।
মৌল কাঠামো বলতে তিনি সমাজের বস্তুগত এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা বুঝিয়েছেন। এর দ্বারা উৎপাদিত শক্তি এবং সামাজিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়।
মার্কস বলেন, অর্থনীতি হলো সমাজের মৌল কাঠামো অন্যদিকে অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা উপরি কাঠামো বলতে, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, পরিবার, শিক্ষা, ধর্ম, সরকার ইত্যাদিকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, অর্থনীতি সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এই অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই সমাজে দু'টি শ্রেণির সৃষ্টি হয়। এক শ্রেণি যারা উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণি। অন্যদিকে যারা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণি।
সমাজে যারা উৎপাদন সম্পর্কের মালিক তারাই উদ্বৃত্ত আত্মসাতের মাধ্যমে শ্রেণি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। উপরের ছকে মার্কসের উৎপাদন ব্যবস্থার দিকগুলো সমাজের শ্রেণি দ্বন্দ্বের ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই না।
মার্কস মূলত শিল্প সমাজের কথাই বলেছেন । মার্কসের ধারণা থেকে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো :
- শ্রেণি সম্পর্কের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক উৎপাদন।
- শ্রেণি সমাজের মূলে আছে শোষণ।
- উৎপাদন সম্পর্কের মালিকানা যা হলো উৎপাদনের উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ।
রাফ ডারেনডর্ফের তত্ত্ব (Theory of Ralf Dahrendorf)
জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ডারেনডর্ফ ( Ralf Gustav Dahrendorf)-এর দ্বান্দ্বিক তত্ত্বটি সমাজবিজ্ঞানে বিশেষ প্রভাব বিস্তারকারী তত্ত্ব। তিনি 'Class and Class Conflict in Industrial Society' গ্রন্থের মাধ্যমে সামাজিক স্তরবিন্যাসের দ্বান্দ্বিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
তিনি সামাজিক স্তরবিন্যাস সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও নিপীড়নের সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দ্বন্দ্বের উপর গুরুত্ব দেয়ার কারণে ডারেনডর্ফের তত্ত্বেও মার্কস ও ওয়েবারের প্রভাব লক্ষণীয়।
তার তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো তিনি মার্কসের তত্ত্বকে খণ্ডন ও গ্রহণ করতে চেয়েছেন। এছাড়া তিনি দলীয় স্বার্থের কথা বলেন। মার্কসও দলীয় স্বার্থের কথা বলেন।
শ্রেণি সম্পর্কে মার্কস যে মডেল দেন ডারেনডর্ফও সেই মডেল দেন। যার একটি মৌল কাঠামো এবং অপরটি অধঃস্তন। ২৪ মার্কস যে শ্রেণিদ্বন্দ্বের কথা বলেন ডারেনডর্ফ তা স্বীকার করেন। কিন্তু মার্কস বলেন শ্রেণি সংগ্রাম একটি পর্যায়ে এসে থাকবে না।
এক্ষেত্রে ডারেনডর্ফ বলেন, যেখানে সমাজ থাকবে সেখানেই দ্বন্দ্ব থাকবে। মার্কস বলেন, শ্রেণিদ্বন্দ্ব হবে কিন্তু অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ডারেনডর্ফ বলেন, কেবল অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব থাকে না।
কারণ শিল্প সমাজের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় উচ্চ শ্রেণির লোকেরা বেশিদিন উৎপাদন সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না। এক্ষেত্রে Managerial class শিল্পকারখানাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মার্কস এই Managerial class এর কথা স্বীকার করেননি।
শ্রেণিদ্বন্দ্বের কথা বলতে গিয়ে ডারেনডর্ফ বলেন দ্বন্দ্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে, থাকবে। প্রত্যেক সমাজে কতকগুলো প্রতিষ্ঠান থাকবে। যেমন—
- ধর্মীয় সংগঠন,
- ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান,
- সরকারি বিভিন্ন সংগঠন,
- শ্রমিক সংগঠন ইত্যাদি।
মার্কস কেবল শিল্প প্রতিষ্ঠানের কথা এবং সমাজে দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। কিন্তু ডারেনডর্ফ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তার কথা বলেছেন। যেমন—
- শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও
- সাধারণ সদস্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব।
ডারেনডর্ফ বলেন সমাজকে কতকগুলো প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার এ প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনগুলোই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।
যেমন— স্কুল, চার্চ ইত্যাদি কর্পোরেশনগুলো যারা শুধু একটিই ক্ষমতা ধারণ করে না। এভাবে রাজনৈতিক এলিট, ম্যানেজার, চার্চ, উপাচার্য ইত্যাদি কীভাবে সমাজে ভূমিকা রাখে তা সারণির সাহায্যে সহজেই বোঝা যায় ।
0 Comments