ময়নামতি প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষসমূহের সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ এখানেই পাওয়া গেছে। ময়নামতি কতকগুলো ছোট পাহাড়ের সমন্বিত রূপ।
এর উত্তর অংশ ময়নামতি, দক্ষিণ অংশ লালমাই এবং মধ্যাংশ শালবন বিহার নামে পরিচিত। ১৮৭৫ সালে রাস্তা পুনঃনির্মাণের সময় স্থানীয় শ্রমিকরা কিছু ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে।
সে সময় এগুলোকে একটি ছোট ইটের দুর্গ মনে করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ময়নামতির ধ্বংসাবশেষ পুনরাবিষ্কৃত হয়।
এ সময় তদানীন্তন সরকার জরিপ চালিয়ে ১৮টি স্থান চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করে। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ময়নামতির খননকাজ শুরু হয়।
খননের জন্য ৫০টির মতো স্থান চিহ্নিত করা হলেও এখনও পর্যন্ত ৯টি স্থানে খননকাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ময়নামতি | Moynamoti
ময়নামতির অবস্থান (Location)
কুমিল্লা শহর হতে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে ঐতিহাসিক ময়নামতি শালবন বিহারের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। ধ্বংসাবশেষ সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে ময়নামতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
ময়নামতির নামকরণ (Naming)
খ্রিস্টীয় ৯ম-১০ম শতাব্দীতে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজারা রাজত্ব করতেন।
লোক সাহিত্য বিশারদ শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন রচিত 'বৃহৎ বঙ্গ" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, চন্দ্রবংশীয় রাজাদের মধ্যে মাণিক চন্দ্র নামে একজন প্রখ্যাত রাজা ছিলেন। মাণিক চন্দ্র সম্ভবত পাটিকারা ও মেহেরকূলের রাজা ছিলেন।
রাজা মাণিক চন্দ্রের মৃত্যুর পর রানী ময়নামতি পুত্র গোবিন্দ চন্দ্রের রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত দীর্ঘকাল মেহেরবূল ও পাটিকারা রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন।
রানি ময়নামতি ছিলেন শিবাবতার গুরু গোরক্ষণাথের উপযুক্ত শিষ্যা। তিনি ছিলেন মহাজ্ঞানের অধিকারি, অসাধারণ যোগশক্তিসম্পন্ন মহাসাধক, অপূর্ব রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন, কর্মকুশল এবং রাষ্ট্র পরিচালক।
তার কর্ম ও সাধনক্ষেত্র তার নামেই চিহ্নিত হওয়ায় বোঝা যায় যে, একসময় তিনি কী রকম গ্রহণযোগ্য ছিলেন।
ময়নামতির অবদান স্মরণ করে প্রাচীন যুগে নাথ-গীতিকা রচিত হয়েছিল। যদিও সে প্রাচীন সাহিত্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছায় নি। তবে অর্ধশতাব্দী পূর্বেও কুমিল্লার ময়নামতি অঞ্চলে রানি ময়নামতিকে নিয়ে পালাগান গাওয়া হতো।
মধ্যযুগের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ রচিত 'গোরক্ষ বিজয়' কাব্যেও রানি ময়নামতির গুনকীর্তন করা হয়েছে। রানি ময়নামতির নাম অনুসারেই এ স্থানের নাম রাখা হয় 'ময়নামতি'।
প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ (Archaeological Relics)
শালবন বিহার (Shalbon vihar)
ময়নামতিতে খনন করে আবিষ্কৃত প্রত্নস্থানসমূহের মধ্যে শালবন বিহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাত শতকের শেষ বা আট শতকের শুরুতে দেব বংশীয় রাজা শ্রী ভবদেব এ বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন।
এ বিহারের প্রতিটি দিকের দেয়াল প্রায় ১৬৮ মিটার করে লম্বা। ১৬ ফুট চওড়া ও ৪-৬ ফুট উঁচু দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত। এর উত্তরদিকে একটি মাত্র প্রবেশপথ। উত্তরদিকে ৫৩ মিটার ফুট দীর্ঘ ইটের নির্মিত রাস্তা আছে।
২২.৫০ মিটার ফুট প্রশস্ত প্রধান তোরণ দিয়ে প্রথমেই ৩০×২৪ ফুট হলঘরে প্রবেশ করা যায়। এ হলঘরের দুপাশে দুটি রক্ষীঘর আছে। বিহারের চারপাশে ১২×১২ ফুট বর্গাকারের সর্বমোট ১১৫টি কক্ষ আছে।
এসব কক্ষে শিক্ষার্থী, ভিক্ষু এবং শ্রমণেরা বাস করতেন। একটা কক্ষ অন্য একটা কক্ষ হতে ৫.৫ ফুট প্রশস্ত দেওয়াল দ্বারা পৃথক। কক্ষগুলোতে কাঠের দরজা লাগানোর ব্যবস্থা ছিল।
চারদিকের কক্ষগুলোর সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া বারান্দা আছে। প্রত্যেক কক্ষে বুদ্ধমূর্তি ও নিত্যব্যবহার্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আসবাবপত্র রাখার জন্য দেওয়ালের গায়ে কুলঙ্গী আছে।
জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রাচীন কীর্তিসমূহের অধিকাংশ এসব কক্ষে পাওয়া গেছে। কয়েকটি কক্ষে ইটের তৈরি বেদীর চিহ্ন আছে। এসব বেদী পূজার কাজে ব্যবহৃত হতো।”
মন্দিরের কার্নিশ জাতক কাহিনি অবলম্বনে গঠিত পোড়ামাটির ফলক চিত্র দিয়ে সাজানো। কার্নিশের কোণায় একমাথা অথচ দু'শরীর বিশিষ্ট সিংহের ফলক চিত্রগুলোর গঠনশৈলীর মধ্যে উচ্চ মননশীলতার পরিচয় মিলে।
দক্ষিণ পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দেওয়ালের গায়ে অনেকগুলো পোড়ামাটির ফলক চিত্র আছে।
সাপের ওপর বেজির ফলক চিত্রটি এর অন্যতম। এছাড়া মাছ, শূকর, ময়ূর, ঘোড়া, বানর, কিন্নরী, যোদ্ধা, রাজহংস, সিংহ ইত্যাদি ফলক চিত্রগুলোতে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনধারার বাস্তব রূপ ফুটে উঠেছে।
এ ধ্বংসস্তূপ হতে সর্বমোট ৬টি তাম্রফলক, ৩টি স্বর্ণ মুদ্রা, ৬টি স্বর্ণের দুল, ২২৪টি রূপার মুদ্রা, ব্রোঞ্জের কাসকেট, বহু বৃদ্ধ ও বৌদ্ধ দেব-দেবীর মূর্তি, কাদামাটির থালা-বাসন, হাঁড়ি, কারুকার্য খচিত ইট ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
আনন্দ বিহার (Ananda vihar)
আনন্দ বিহার প্রত্নস্থলটি ময়নামতি জাদুঘর ও শালবন বিহার থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার উত্তরে সেনানিবাস এলাকায় ভোজ বিহারের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। ১৯৭৫ সালে এ প্রত্নস্থলে সর্বপ্রথম নিয়মিত খনন শুরু হয় এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।"
এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। এ বিহারটি যে টিবিতে অবস্থিত তাকে স্থানীয়রা আনন্দ রাজার বাড়ি' নামে চেনে। বিহারটি চারদিকে মঠ, স্তূপ ও উপাসনালয় নিয়ে গঠিত।
খ্রিস্টীয় সাত শতকের শেষ অথবা আট শতকের শুরুর দিকে দেব বংশীয় রাজা শ্রী আনন্দদের বিহারটি নির্মাণ করেন। বিহার সংলগ্ন রানির প্রাসাদ ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সমতল ভূমি হতে ১২ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এখানে স্থানীয়ভাবে পরিচিত 'গোপী চাঁদের সুড়ঙ্গ' অবস্থিত।
এখানে দুটি সোনার চুড়ির ভগ্নাংশ, দুটি পিতলের আংটি, পিতলের শলা, অলংকৃত ইট, ফলকচিত্র ও কয়েকটি পাথরের টুকরা আবিষ্কৃত হয়েছে। আনন্দ বিহারে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকচিত্রের মধ্যে রয়েছে নর ও নারী, যক্ষ, রাজহংস, মকর, বন্য শূকর ইত্যাদি।
এছাড়া এখানে অসংখ্য মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে রান্নার পাত্র, বিভিন্ন ধরনের থালাবাটি, প্রদীপ ইত্যাদি অন্যতম। আনন্দ বিহারে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জ মূর্তির মধ্যে আট হাত বিশিষ্ট তারা মূর্তি অন্যতম।
এ বিহারের পাশেই 'আনন্দ রাজার দিঘি' নামে পরিচিত একটি জলাশয় আছে। জলাশয়টি সম্ভবত আনন্দ বিহারের প্রয়োজনে খনন করা হয়েছিল।
ভোজ বিহার (Bhojh vibar)
ময়নামতিতে শালবন ও আনন্দ বিহারের পর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ভোজ বিহার। বর্গাকারে নির্মিত এ বিহারের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৩৭ মিটার। প্রতিটি বাহুতে ভিক্ষুদের বসবাস ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে ছোট ছোট কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছিল।
শালবন ও আনন্দ বিহারের মতো ভোজ বিহারেও উন্মুক্ত আঙ্গিনার মাঝখানে একটি ক্রুশ আকৃতির বড় মন্দির আছে
কৌটিলা মুড়া (Koutila mura)
শালবন বিহার হতে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে কৌটিলা মুড়া নামে একটি অনুচ্চ পাহাড়ের তিনটি স্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত এ স্তূপগুলোকে বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি মূল দার্শনিক ধারণা তথা বৃদ্ধ (জ্ঞান), ধর্ম (ন্যায়) এবং সংঘ (শৃঙ্খলা) রূপে কল্পনা করা হয়েছে।
স্তূপগুলোর এ ধরনের ধর্মীয় তাৎপর্য দেখে মনে হতে পারে, বাংলার এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির বেশ প্রভাব ছিল। ভূমি পরিকল্পনার দিক থেকে এ স্তূপগুলো শালবন বিহারে আবিষ্কৃত কেন্দ্রীয় মন্দির ও স্তূপগুলোর চেয়ে ভিন্ন ধরনের।
এগুলোর ভিত্তিবেদি ছিল বর্গাকার, কিন্তু শালবন বিহারের স্তূপের ভিত্তিবেদি গোলাকার। এ স্তূপ তিনটির পশ্চিম দিকে আরও অসংখ্য স্তূপ ছিল।
এগুলোর মধ্যে ১টি স্তূপের ভিত্তিবেদি আবিষ্কার হয়েছে। বাকিগুলো ইট হরণকারীদের দৌরাত্ম্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
রূপবান মুড়া (Rupban mura)
এটি স্থানীয়ভাবে রূপবান কন্যার বিহার নামে পরিচিত। কিন্তু খননের পর দেখা যায়, “এটি মূলত সমাধি মন্দির। এখানে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গুপ্ত যুগের স্বর্ণমুদ্রা, ৭টি লৌহ মুদ্রা, বৌদ্ধমূর্তি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এসব নিদর্শনের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, এই সমাধিস্থল বা মঠগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকের।" এখানে একটি তাম্রলিপি পাওয়া গেছে। তবে এর পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
চারপত্র মুড়া (Charpatra mura)
এটি কৌটিলা মুড়া থেকে ২.৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র আয়তাকার সমাধিস্থল। এ সমাধিস্থলের পূর্বদিকে একটি মাত্র প্রবেশদ্বার, যার মাথায় রয়েছে একটি প্রশস্ত হল।
এখানে অসংখ্য সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। এখানে ৪টি তাম্রশাসন ও ১টি ব্রোঞ্জের ধাতুফলক আবিষ্কার হয়েছে।
ইটখোলা মুড়া (Itakhola mura)
কোটবাড়ি সড়কের পাশে রূপবান মুড়ার বিপরীতে ছোট টিলাটিতে তিন স্তরে ইটাখোলা মুড়া প্রত্নস্থলটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।
এখানে খননের ফলে উত্তর দিকে সংযুক্ত মঠসহ একটি সুবৃহৎ স্তূপ কমপ্লেক্স উন্মোচিত হয়েছে।
এ স্থানে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য প্রাচীন নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে নিরেট সোনার তিনটি গোলক, একটি তাম্রশাসন ইত্যাদি। এখনও তাম্রশাসনটির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি।
চুন্না মুড়া (Chulla mura)
চারপত্র মুড়ার উত্তর দিকে একটি ছোট মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। তবে টিবিটি এমনভাবে ধ্বংস হয়েছে যে, এখন আর মন্দিরটির বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।
বড়গাছ মুড়া (Borogach mura)
লালমাই পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। বড়গাছ মুড়া মন্দিরটি প্রায় ১৮-১৯ মিটার প্রশস্ত ছিল।
চণ্ডী মুড়া (Chondi mura)
লালমাই পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তে পাশাপাশি অবস্থিত ইটের তৈরি দুটি ছোট মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।
মন্দির দুটি একই ধরন ও মাপের। প্রতিটির আয়তন ৩.৬৩ মিটার × ৩.৬৩ মিটার এবং উচ্চতা ৪.৫৪ মিটার। মন্দির দুটির একটিতে শিব ও অন্যটিতে চণ্ডীর পূজা হতো।
পাকা মুড়া (Pakka mura)
কোটবাড়ি ধ্বংসাবশেষের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে শৈলরাজির পশ্চিম সীমান্তে অখননকৃত পাক্কামুড়া ময়নামতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
এর একাংশ বিরাট এক জলাশয়ে রূপান্তর হয়েছে, যা ‘তারা দিঘি' নামে পরিচিত। এর গভীরতম মধ্যাংশ বর্তমানে দুটি পুকুরে রূপান্তর করা হয়েছে।
পুকুর খননের সময় বিষ্ণুর দুটি আকর্ষণীয় কালো প্রস্তর মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে পরবর্তী দেব বংশের দামোদরদেবের পুত্র দশরথ দেবের একটি তাম্রশাসন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।
ময়নামতির সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব (Social and historical importance of Moynamoti)
ময়নামতিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ থেকে যেসব প্রাচীন সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে প্রাচীন বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের একটি চিত্র ফুটে ওঠে।
এসব ধ্বংসাবশেষ থেকে সে যুগের সংস্কৃতির যে উপাদান পাওয়া গেছে, তাতে সহজেই বলা যায় ময়নামতি অঞ্চল কেবল অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল না, অতীতেও এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এদেশের সামাজিক ইতিহাস রচনায় ময়নামতির ধ্বংসাবশেষ বিশেষ অবদান রেখেছে।
ময়নামতিতে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্লেষণে জানা যায়, কুমিল্লা অঞ্চলে কয়েকশত বছরব্যাপী বৌদ্ধ ধর্ম, সমাজ সংস্কৃতি তথা বৌদ্ধ সভ্যতার এক স্বর্ণযুগ কেটেছে।
ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত তথ্য বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাসে ময়নামতির ধ্বংসাবশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্য চিত্র হিসেবে স্বীকৃত থাকবে।
ময়নামতিতে স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ নির্মিত অলংকারাদি, লোহার দ্রব্যাদি, কাঠ নির্মিত দ্রব্যাদি, মৃৎ পাত্রাদি, অলংকৃত ইট, প্রস্তুর ভাস্কর্য, তামার পাত্র এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র তৎকালীন সমাজের জীবন ও সভ্যতার এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে।
প্রাচুর্যে, বৈচিত্র্যে ও বর্ণনা সৌষ্ঠবে তৎকালীন শিল্পীরা অপূর্ব দক্ষতা অর্জন করেছিল বলে আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদগুলো সাক্ষ্য দেয়।
মুদ্রা আবিষ্কার হওয়ায় বোঝা যায় যে, এখানে একটি সুদক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা চালু ছিল। এখানে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে রাজার জমি দানের বিষয়টি লিপিবদ্ধ আছে।
এর মানে ভূমিতে ব্যক্তি মালিকানা ছিল। আর ব্যক্তি মালিকানা সামাজিক স্তরবিন্যাসের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।
সর্বোপরি ময়নামতিতে আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রমান করে যে, এই এলাকাটি ছিল প্রাচীন বঙ্গ-সমতটের (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র।
0 Comments