ধাতু হিসেবে লৌহের ব্যবহার মানব সভ্যতার উৎকর্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়। বস্তুত নগর সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ সম্ভব হয়েছে ধাতু হিসেবে লোহার ব্যবহারের ফলেই লৌহযুগের প্রচলন আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ হতে শুরু হয়।
লৌহ যুগ | Iron Age
বর্তমানে যে অঞ্চলটি আধুনিক আর্মেনিয়া নামে পরিচিত সে অঞ্চলে বসবাসরত বর্বর উপজাতিরা সর্বপ্রথম লোহার হাতিয়ার তৈরি করেছিল।
তবে এশিয়া মাইনরে বসবাসরত হিট্টাইটরা সর্বপ্রথম লৌহ শিল্পের সূচনা করে। পরবর্তী সময়ে আসিরীয়রা লৌহের ব্যবহার শুরু করে। ধীরে ধীরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, নিকট প্রাচ্য ও ইউরোপে লৌহের ব্যবহার শুরু হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ অব্দে ইউরোপের ক্রিট দ্বীপ ও গ্রিসে লৌহ যুগের সূচনা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে ব্রিটেনে ব্যাপকভাবে। লোহার ব্যবহার শুরু হয়।
ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ মর্টিমার হুইলার (Robert Eric Mortimer Wheeler)-এর মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ভারতে লোহার ব্যবহার শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে চীনেও লৌহ যুগের সূচনা ঘটে।
ভারত থেকে লোহার ব্যবহার ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মালয়, পোলিনেশিয়া ও আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যে প্রস্তর যুগের অবসানের সাথে সাথে লোহার ব্যবহার প্রচলিত হয়।
তারা তামা বা ব্রোঞ্জ কোনোটিরই ব্যবহার জানত না। আপানে ব্রোঞ্জ ও লৌহের ব্যবহার একসতো শুরু হয়।
সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশে লৌহ যুগের প্রভাব (Impact of Iron Age on the Development of Society and Civilization)
লোহার ব্যবহার মানবসভ্যতা বিকাশে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কৃষিকাজের উদ্ভব যেমন মানুষের জীবনধারাকে পাল্টে দিয়েছিল, লোহার ব্যবহার কালক্রমে মানুষের জীবনধারায় তেমনি বিরাট পরিবর্তন এনেছে।
নগর সভ্যতার উদ্ভব (Origin of Civilization)
নগর সভ্যতার উদ্ভব লৌহ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আধুনিক সভ্যতার ভিত্তিই হচ্ছে লোহা। লোহার যন্ত্র ব্যবহারের ফলে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে ফসলের পরিমাণও বেড়ে যায়।
এ উদ্ধৃত ফসল রাজা, পুরোহিত ও ভূমির মালিকদের হাতে জমা হয়। তাদের মাঠে কাজ করতে হয় না, অথচ তাদের আরাম-আয়েশের অতিরিক্ত সুযোগ তৈরি হয়।
পাশাপাশি আরাম-আয়েশের নতুন নতুন উপকরণ ও বিলাসব্যসন বাড়তে থাকে। এ বিলাস ব্যসনের উপকরণ সংগ্রহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন উপভোগের প্রয়োজনে গড়ে উঠল নগর। ফলে নগর সভ্যতার সৃষ্টি হলো এবং বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলো নগরে রূপ নিল।
উৎপাদন ব্যবস্থা (Production system)
লোহার হাতিয়ার ব্যবহার উৎপাদনে অভাবনীয় প্রাচুর্য এনে দিয়েছিল। লোহার হাতিয়ার পাথরের হাতিয়ারের চেয়ে অনেক বেশি উপযোগী।
কারণ লোহার হাতিয়ারে ইচ্ছামতো আকার দেওয়া যায় এবং এগুলো পাথর, তামা বা ব্রোঞ্জের চেয়ে শক্ত ও অনেক বেশি ধারালো। এছাড়া লোহা ওজনে পাথরের চেয়ে হালকা হওয়ায় এটা নিয়ে তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার সহজ হয়।
লোহার হাতিয়ার মানুষের কর্মদক্ষতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রস্তর যুগে জমি চাষের সময় পাথরের ফলা মাটির গভীরে যেতো না।
- তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগ | Copper & Bronze Age
- নব্যপ্রস্তর যুগ | Neolithic Age
- প্রত্নতত্ত্বের উৎস | Sources of Archaeology
কিন্তু লৌহ যুগে লোহা নির্মিত শঙ্ক অথচ হালকা এবং ধারালো ফলা মাটির গভীরে প্রবেশ করে জামিকে সহজেই চাষযোগ্য করে দেয়। এ যুগে লৌহ নির্মিত কাস্তে, দা, কুড়াল ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়।
কার্যত নতুন ধরনের হাতিয়ার প্রয়োগের ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়ে গেল। সর্বোপরি লোহার উদ্ভবের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় যন্ত্রচালিত শক্তির ব্যবহার সম্ভব এবং শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়েছে
শ্রমবিভাজন (Division of labour)
লোহার ব্যবহারের ফলে শ্রমবিভাজন বৃদ্ধি পায়। লোহা উত্তোলনের কাজে একদল বিশেষজ্ঞ শ্রেণি তৈরি হয়।
যেখানে খনি আবিষ্কৃত হতো, সেখানে খনির কাজে বিশেষজ্ঞ লোক জড়ো এবং ঘনিকে কেন্দ্র করে নগরের পত্তন হতো।
শ্রমিকরা ধাতু উত্তোলন ও হাতিয়ার নির্মাণ এ দুটো কাজে বিভক্ত হয়ে পড়ত। কৃষক কৃষিকাজ নিয়ে এবং হাতিয়ারের জন্য হাতিয়ার শিল্পে নিয়োজিত শিল্পকর্মীর মুখাপেক্ষী হতো।
ধাতু উত্তোলন, হাতিয়ার নির্মাণ ও কৃষিকাজ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শ্রমবিভাজন সৃষ্টি হতো ।
লিপির উন্নয়ন (Development of alphabet)
লিপির আবিষ্কার সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ব্রোঞ্জ যুগে লিপি ব্যবহারের সূচনা হলেও তা পরিপূর্ণতা লাভ করে লৌহ যুগে এসে।
নগরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছিল। ফলে লেনদেন, চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে দলিলের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ প্রয়োজন মেটানোর জন্য লিপির উদ্ভব ঘটে।
ব্রোঞ্জ যুগে মিশরীয়রা যে চিত্রভিত্তিক হায়ারোগ্লিফিক লিপির উদ্ভাবন করেছিল, লৌহ যুগে ফিনিশীয়রা তার উন্নতি ঘটিয়ে বর্ণভিত্তিক লিপির আবিষ্কার করে। তাদের বর্ণমালায় ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল।
পশুর ব্যবহার (Use of animal)
লৌহযুগের শুরুতে ঘোড়া পালন পদ্ধতি উন্নত হতে থাকে এবং ঘোড়ার পিঠে আরোহণ শুরু হয়।
মজার বিষয় হলো, মানুষ ঘোড়ার ব্যবহার জানা সত্ত্বেও সুদীর্ঘ এক হাজার বছর পর ঘোড়ায় আরোহণ শুরু করে। সম্ভবত অশ্বের পূর্বে মানুষ উটে আরোহণ করত।
সুমেরিয়ান সভ্যতায় শুরুতে মানুষ গাধার পিঠে আরোহণ করত। ঘোড়া পালন পশ্চিম ইরানে হামাদানের নিকটবর্তী মিডিস (Medes) জাতি প্রথম শুরু করে। মধ্য এশিয়ার মানুষ ঘোড়া পালন করত দুধ ও মাংসের জন্য।
ইরানে ঘোড়ায় আরোহণ শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর আগে। এর আরকাল পরে মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে, গ্রিস এবং ইতালিতে ঘোড়ায় আরোহণ শুরু হয়।
এছাড়া উটের দ্বারা পণ্য চলাচল হতো বেলুচিস্তানে, আরবে ও সাহারাতে। ভারত ও আফ্রিকা পর্যন্ত এই বাণিজ্য চলত।
চাকার ব্যবহার (Use of wheel)
মানুষের প্রযুক্তিজ্ঞানের বিকাশে ঢাকার উদ্ভাবন এক মাইলফলক। ঢাকার নানারকম ব্যবহার লৌহ যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। লৌহ যুগে ঢাকা যুক্ত শট আবিষ্কৃত হয়।
ঢাকা আবিষ্কারের ফলে যাতায়াত, পণ্য পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারবার বৃদ্ধি পায় ও শ্রমবিভাগ প্রসারিত হয়। শুধু যানবাহনে নয়, ঢাকা শিল্পকর্মেও নতুন ধারা প্রবর্তন করে।
বিশেষ করে চাকা ব্যবহারের ফলে মৃৎশিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। চাকার আবিষ্কারের ফলে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করতে সমর্থ হয়। ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভাবের আদান প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
- তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগ | Copper & Bronze Age
- নব্যপ্রস্তর যুগ | Neolithic Age
- প্রত্নতত্ত্বের উৎস | Sources of Archaeology
গর্ডন চাইভ চাকার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেন, “ঢাকা কাঠের কাজে প্রাগৈতিহাসিক যুগের পরম কৃতিত্ব এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির পূর্বশর্ত।” উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লৌহ যুগ মানব সমাজ ও সভ্যতা বিকাশের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
লৌহ যুগের আবির্ভাবের সাথে সাথে মানব সমাজ ও সভ্যতার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, যা পরবর্তীতে আধুনিকতার সূচনাকে ত্বরান্বিত করে।
0 Comments