হলোসিন যুগের (খ্রিষ্টপূর্ব ১১,৬৫০ বছর আগে শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ যুগের সময়সীমা) শুরু থেকে খ্রিস্টের জন্মের সাড়ে ৩ হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত নব্যপ্রস্তর যুগের সময়সীমা। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ অব্দে মধ্যপ্রাচ্যে নব্যপ্রস্তর যুগের সূচনা হয়।
পরবর্তী সময়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে এবং সবশেষে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে বর্তমান ব্রিটেনে এ যুগের যাত্রা শুরু হয়।
এই যুগই আমেরিকান সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান ( Lewis Henry Morgan) বর্ণিত বর্বরদশা (Barbarism)।”
নব্যপ্রস্তর যুগ | Neolithic Age
পুরোনো প্রস্তর যুগের মানুষ প্রকৃতিকে পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারে নি (তাদের খাদ্য নির্ভর করত প্রকৃতির সরবরাহের ওপর।
কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতিনির্ভর ছিল না, তারা প্রকৃতিকে কিছুটা আয়ত্তে এনে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে শিখেছিল।
এসব উন্নতি লক্ষ করে অস্ট্রেলিয়ান নৃবিজ্ঞানী ভি. গর্ডন চাইল্ড (Vere Gordon Childe) এ যুগকে 'নবোপলীয় বিপ্লব (Neolithic Revolution)' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নবোপলীয় যুগের মানুষ শিল্পকলায়ও অনেক অবদান রেখেছিল ।
তারা তাঁতের সাহায্যে পোশাক, ঘরবাড়ি, নৌকা, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল এ যুগের মানুষই প্রথম ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিময় প্রথার প্রচলন করে ।
সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে নব্যপ্রস্তর যুগের প্রভাব (Impact of Neolithic Age on the Development of Society and Civilization)
১. সামাজিক সংগঠন (Social organization)
যেকোনো সমাজের মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক সংগঠন। নব্যপ্রস্তর যুগে যেকোনো ধরনেরই হোক কিছু সামাজিক সংগঠন ছিল, যা গোষ্ঠীজীবনে শৃঙ্খলা ও সংহতি বজায় রাখত। এ যুগে সামাজিক সংগঠনের ভিত্তি ছিল টোটেম বিশ্বাস।
অর্থাৎ তারা বিশেষ কোনো বৃক্ষ, জন্তু বা অন্য কিছুকে পূজা করত । এ ধরনের বিশ্বাস, প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গোত্রগুলো কোনো বিশেষ প্রাণি বা গাছপালার সাথে একটি বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করত।
এ যুগের মানুষের ধ্যান-ধারণা ও মতাদর্শের ভিত্তি ছিল অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কার।
২. অর্থনৈতিক অবস্থা (Economic system)
এ যুগে প্রত্যেকটি গ্রাম বা সংগঠনই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থাৎ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সমস্ত খাদ্য ও উপকরণ গ্রামের মানুষেরা নিজেরাই উৎপাদন করত।
এ যুগের মানুষ কৃষি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে এবং প্রকৃতিকে বশে আনতে সক্ষম হয়।
কৃষিতে লাগুলের ব্যবহার যখন শুরু হয় তখন আর মেয়েরা শারীরিকভাবে শ্রমদান করত না। যদিও কৃষির আবিষ্কার নারীরাই করেছিল।
এখান থেকেই নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য শুরু হয়। তাই বলা হয়, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি।
৩. হাতিয়ার আবিষ্কার (Innovation of arms)
অস্ট্রেলিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ ডি গর্ডন চাইল্ড মন্তব্য করেছিলেন, “নব্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বস্তুনির্ভর জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটে গেল।”
বীজের তুষ ছাড়াবার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র পাথরে ঘষে কিংবা পাথর দিয়ে ঘা মেরে তৈরি হওয়া মসৃণ হাতিয়ার আপনা-আপনি একটু একটু করে উন্নত হয়ে উঠতে লাগল।
গর্ডন চাইল্ড-এর যুক্তি হলো একবার যেই নব্যপ্রস্তর যুগে হাতিয়ার তৈরি করা শুরু হয়ে গেল, অমনি জমি চাষ করা অনেক সহজ হলো।
সিন্ধু সভ্যতাসহ অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে খনন কাজের ফলে আমাদের এই উপমহাদেশ কেমন করে এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হয়ে উঠল সেটা আমরা ভালোভাবে দেখতে পাই।
অনেকের মতে, সিন্ধু অববাহিকার পশ্চিম তটভূমিতে অবস্থিত মেহেরগড়ে (বেলুচিস্তান) খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৩৮০০ পর্যন্ত এই বিপ্লবের প্রধান প্রধান চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। ১৫
৪. কৃষির উদ্ভব (Innovation of agriculture)
নব্যপ্রস্তর যুগেই কৃষির উদ্ভব ঘটে। আর কৃষির উদ্ভবের সাথে সাথে মানুষ স্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তোলে।
প্রত্নতত্ত্ববিদ, নৃতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন, কৃষি বিপ্লবের সূচনা হয় পশ্চিম এশিয়ার ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট' অঞ্চল থেকে।
এ অঞ্চলটি পারস্য উপসাগর, আধুনিক জর্ডান, লেবানন, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইসরাইল ও মিশরের উত্তর অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এ অঞ্চলেই প্রথম কৃষিভিত্তিক সমাজের উদ্ভব হয়েছিল ।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের খনন কাজের ফলে পশ্চিম এশিয়ার বেশ কয়েকটি স্থানে নব্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতি আবিষ্কার হয়েছে। এসব স্থানে গম, বার্লি চাষ, কৃষি সংশ্লিষ্ট মৃৎপাত্র, বিভিন্ন হাতিয়ার এবং পশু পালনের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
৫. সাংস্কৃতিক বিকাশ (Cultural development)
সাংস্কৃতিক বিকাশ যেকোনো সমাজ বা গোষ্ঠীর অন্যতম দিক। নব্যপ্রস্তর যুগেও ব্যতিক্রম ঘটেনি।
নব্যপ্রস্তরযুগে সাংস্কৃতিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য সংযোজনের মধ্যে রয়েছে মৃৎপাত্র তৈরি, বন্যপশুকে গৃহপালিত পশুতে রূপান্তরিত, কৃষিকাজে বিভিন্ন হাতিয়ারের ব্যবহার, বয়নশিল্প ও স্থাপত্যশিল্পের উদ্ভব, স্থায়ী বসতি নির্মাণ কৌশল, বাগিচা বা উদ্যান চাষাবাদ, বিনিময় ব্যবস্থা, অতি প্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস, জাদুবিদ্যা, উদ্বৃত্ত ও সঞ্চয়, সম্পত্তির চেতনা ইত্যাদি।
অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, পশুকে পোষ মানানো ও কৃষির উন্নতি সাধনই ছিল নব্যপ্রস্তর যুগের প্রকৃত ভিত্তি ।
বি.দ্র:
নব্যপ্রস্তর যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উদ্বৃত্ত খাদ্যের উৎপাদন। এ যুগে স্থানীয় প্রয়োজন মেটানোর পরও বাড়তি খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয়। ফলে কৃষিতে সব লোকের প্রয়োজন হয় না। অনেকে হস্তশিল্পের কাজ শুরু করে এবং বাজার ও শহর গড়ে ওঠে।
৬. ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব (Origin of private ownership)
এ যুগে জমিতে যৌথ মালিকানা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বস্তুত কৃষি আবিষ্কারের অন্যতম ফল হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভব। তখন কৃষি ব্যবস্থায় যৌথ প্রচেষ্টার চেয়ে ব্যক্তি প্রচেষ্টা অধিক ফলদায়ক ছিল।
কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন জমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষের আওতায় আনয়নের মাধ্যমে যৌথ সম্পত্তির চেয়ে ব্যক্তি সম্পত্তি বড় হয়ে দাঁড়াল।
৭. বিনিময় ও ব্যবসা-বাণিজ্য (Exchange, trade-commerce)
এ যুগে একটা বা দুটো দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় সীমাবদ্ধ ছিল। তখন যার যা প্রয়োজন, সেজন্য বিনিময় ইচ্ছুক অন্য ব্যক্তি খুঁজে নেওয়া কঠিন ছিল না।
কিন্তু বিনিময় শুধু ফসল, লবণ বা মৃৎপাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি।
উদ্বৃত্ত ফসল যতই বেড়েছে, বিনিময়ের সামগ্রী তত বৃদ্ধি পেয়েছে। এ যুগে বিনিময় প্রথা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কারিগরি জ্ঞানের উন্মেষ এবং আদান-প্রদান ঘটিয়েছিল।
বিনিময় প্রথায় সৃষ্ট নানারকম অসুবিধা দূর করার জন্য বিনিময়ের মাধ্যম ও ব্যবসায়ী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।
৮. পরিবারের উৎপত্তি (Origin of family)
কৃষির বিকাশের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সফলতা আসে। আর অর্থনৈতিক সাফল্যের ফলশ্রুতিতে সমাজে পরিবার প্রথার উদ্ভব ঘটে। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি মিলে গঠিত হয় একটি সুসংহত গোষ্ঠী।
তারা সবাই মিলে একত্রে এক টুকরা জমিতে নিরিবিলি কাজ করতে পারে। তাদের পরস্পরের স্বার্থ, এক ও অভিন্ন । এমন ধারণা থেকেই নব্যপ্রস্তর যুগে পরিবার বিকাশ লাভ করে।
৯. ধর্মীয় জীবন (Religious life)
নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ আত্মার ধারণায় বিশ্বাস করত। তারা মনে করত, আত্মা বা প্রেতাত্মা মানুষের ক্ষতি করতে পারে।
এজন্য তারা আত্মা-প্রেতাত্মা বা অতিপ্রাকৃত শক্তির হাত থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে নানারকম আচার-অনুষ্ঠান পালন করত।
এসবের পাশাপাশি নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষরা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের (গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি) পূজাও করত ।
0 Comments