সভ্যতার উষালগ্নে পৃথিবীর বিশেষ কয়েকটি অঞ্চল অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করে। এসব অঞ্চলকে প্রাচীন সভ্যতার উৎসভূমি বলা হয়।
বাংলাদেশের সভ্যতা বিকাশে সিন্ধু সভ্যতার অবদান
সিন্ধু উপত্যকায় গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতা এ উৎস ভূমিগুলোর অন্যতম। প্রাচীন মানব সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতা এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
এককালে ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটি ধারণা ছিল যে, গ্রিসকে কেন্দ্র করে বিশ্ব সভ্যতার সৃষ্টি। আর ইউরোপীয়দের বিশ্বাস হলো, আর্য জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পূর্ব পর্যন্ত এ উপমহাদেশের জনগণ ছিল বর্বর।
পরবর্তী সময়ে ১৯২৪ সালে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার ধ্বংসস্তূপের সংবাদ প্রচার হলে এই অন্যদের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে বিশ্ববাসী অবগত হয়।
বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় সিন্ধু নদের উপকূলে মহেঞ্জোদারো ও পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলায় হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
সিন্ধু নদীকে কেন্দ্র করে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটে। সিন্ধু সভ্যতা এশিয়ার প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর প্রায় সমযুগের।
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার নগরজীবনের ধরন, মান ও সমৃদ্ধিকে লক্ষ করে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার জনগণ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উৎকর্ষতার চরম শিখরে উপনীত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে।
ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ জন হাবার্ট মার্শাল (John Hubert Marshall) এই সভ্যতা সম্পর্কে বলেন, "The discovery of this (Indus valley) civilization has revised our ideas of the entiquity of Indian civilization."
সিন্ধু সভ্যতার প্রেক্ষাপট (Background of Indus valley)
ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক মিশন ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বোলান নদীর তীরে অবস্থিত মেহরগড়ে এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে Scientific American পত্রিকায় জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
এ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৫ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে সভ্যতার সূচনা হয়। " এই সভ্যতা সাত স্তরবিশিষ্ট এবং সপ্তম পর্বের সময়কাল ২৯০ খ্রিস্টপূর্ব।
এই পর্বের কিছু মৃৎপাত্র ও অন্যান্য নিদর্শনগুলোর সাথে হরপ্পা সভ্যতার মিল আছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। অনেকের ধারণা সিন্ধু সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল।
সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি (Expansion of Indus Civilization)
সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার তুলনায় এ সভ্যতার ভৌগোলিক বিস্তৃতি বেশি ছিল। এই সভ্যতাকে তিনটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে।
যথা— মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও চানহু-দারো। সরস্বতী শতদ্রু উপত্যকা থেকে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সভ্যতা। উত্তর-দক্ষিণে ১,১০০ কি. মি. এর বেশি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১,৬০০ কি. মি. এর অধিক এলাকাজুড়ে এ সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল।
- তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগ | Copper & Bronze Age
- নব্যপ্রস্তর যুগ | Neolithic Age
- প্রত্নতত্ত্বের উৎস | Sources of Archaeology
১৯৪৭ সালের পর একাধিক খননকার্যের ফলে স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে।
এসব অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে পূর্ব পাঞ্জাবের অন্তর্গত রূপত্ব, চণ্ডীগড়, রাজস্থানের অন্তর্গত কালিবাঙ্গান: হিসার জেলার অন্তর্গত বনওয়ালি দৌলতপুর ও মিটাথাল; উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত আলমগীরপুর, গুজরাটের অন্তর্গত কুচ জেলা ইত্যাদি।
বর্তমানে গুজরাটের কুচ অঞ্চলে ভুল শহরের কাছে ঢোলারীরাতে ৫০ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে একটি দুর্গবেষ্টিত শহরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, যা সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত বলে চিহ্নিত হয়েছে।
আবিষ্কার (Discover)
১৮৭৫ সালে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা আলেকজান্ডার কানিংহাম পাঞ্জাবে রাজী নদীর তীরে হরপ্পা নামক স্থানে কিছু অজ্ঞাত লিপি, মূর্তি ও কিছু সীলমোহর দেখতে পান।
তারপর ১৯২৪ সালে খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে মহেঞ্জোদারো নামক স্থানে একটি বিশাল ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কার করেন।
এটাকে বৌদ্ধযুগের বলে ধারণা করা হয়। এই ধ্বংসস্তূপের ভিতর হরপ্পার সীলমোহরের মতো কিছু সীলমোহর ও চকমকি প্রস্তরের হাতিয়ার দেখতে পাওয়া যায়।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তদানীন্তন অধিকর্তা স্যার জন মার্শাল এর তত্ত্বাবধানে মহেজোদারো ও হরপ্পার খননকার্য শুরু হয়।
১৯২১-৩৪ সালে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে ই, ম্যাকে, কালিনাথ দীক্ষিত, এম. হুইলার, ননী গোপাল মজুমদার প্রমুখের নেতৃত্বে বেশ কিছু খনন কাজ পরিচালিত হয়।
এরপর ১৯৬১-৬৯ সালে বি. বি. লাল ও বি. কে. থাপারের নেতৃত্বে খননকাজ চালিয়ে রাজস্থানের কালিবঙ্গান' প্রত্নস্থান আবিষ্কার হয়।
সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক এবং এর কীর্তি ও অবদান
সিন্ধু সভ্যতা এ উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক কাঠামো রূপায়নে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। নিচে সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক এবং এর কীর্তি ও অবদান আলোচনা করা হলো:
নগর জীবন (City life)
সিন্ধু সভ্যতা নদীবেষ্টিত হওয়ার ফলে কৃষি অর্থনীতি ছিল এ সভ্যতার মূল শক্তি।
বাড়তি উৎপাদনের কারণে এ সমাজে গড়ে ওঠে অবসর জীবনযাপনকারী শ্রেণি, সুষ্ঠু পরিকল্পিত নগরজীবন এবং সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা সমৃদ্ধ উন্নত জীবনবোধ।
নগরের রাস্তাগুলো ছিল বেশ প্রশস্ত অর্থাৎ ৩ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত, যা বেশ দূরের ব্যবধানে পরস্পরকে ছেদ করে আয়তকাররূপ নিয়েছে।
এছাড়া ছোট ছোট গলি রাস্তা ছিল। রাস্তায় নিয়মিত ব্যবধানে ল্যামপোস্টের ব্যবস্থাও চালু ছিল। নগরের ভবনগুলো ছিল পোড়ানো ইটের তৈরি।
সিন্ধু সভ্যতায় স্বাস্থ্যকর নাগরিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রয়োজনীয় গোসলখানা, পয়ঃপ্রণালি, পৌরসভা, সুশৃঙ্খল প্রশাসন, উন্নত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, খাজনা আদায় প্রথা তথা নগর জীবনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান ছিল।
বড়, মাঝারি ও ছোট আকারের প্রাসাদ এবং আবাসিক ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে সমাজে বিদ্যমান সামাজিক স্তরবিন্যাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। ভবনগুলো উন্নত শিল্পমানের না হলেও আরামে বসবাসযোগ্য ছিল।
প্রতিটি বাড়ির ছিল প্রশস্ত বারান্দা-জানালা। বাড়িগুলোতে রূপ, নর্দমা ও গোসলখানারও সমাবেশ ছিল। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন হচ্ছে ৩০×৩৩ মিটার আয়তনের 'বৃহৎ স্নানাগার।
এটার অবস্থান ছিল নগর দুর্গের ঠিক মাথায়। মর্টিমার হুইলারের (Mortimer Wheeler) মতে, স্নানাগারটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। স্নানাগারের পাশেই ৪৬×২৩ মিটার আয়তনের শস্যাগার ছিল।
এছাড়া ২৪ বর্গমিটার আয়তনের একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা সভাকক্ষ বলে চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বহু সংখ্যক নিচু বেদী ও চারিদিকে প্রশস্ত বারান্দা। অর্থাৎ বর্তমান নাগরিক জীবনের সব উপকরণই সেখানে বিদ্যমান ছিল।
বাড়িঘরের ধরন (Housing pattern)
সিন্ধু সভ্যতায় বাড়িগুলো একতলা এবং দোতলা ছিল। বেশিরভাগ বাড়িই শুকনো ইটের দ্বারা নির্মিত ছিল প্রত্যেক বাড়িতেই পানির ব্যবস্থা ছিল।
বাড়িতে বৈঠকখানা, গোসলখানা ও স্যানিটারি ব্যবস্থা দেখা গেছে। বাড়িগুলোতে প্রতিরক্ষার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থাও ছিল।
'ভাষা ও লিপি (Language and alphabet)
মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসস্তূপে সিন্ধু সভ্যতার যুগে প্রচলিত লিপির কয়েকটি নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এগুলোর পাঠোদ্ধার করা যায়নি।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে হরপ্পায় প্রায় ২৭০ ধরনের অক্ষর বা হরফ প্রচলিত ছিল। গবেষকদের মতে, সিন্ধু সভ্যতায় প্রথম দিকে লেখার জন্য ৩৬০টি চিহ্ন ব্যবহার করা হতো।
শেষে হরপ্পা যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০ অব্দ) চিহ্ন সংখ্যা কমে ২০টিতে দাঁড়ায়। এখানে সীলমোহরগুলোর ওপর ষাঁড়, ছাগল, বাঘ, হাতি প্রভৃতি জন্তুর প্রতিচ্ছবিও খোদিত আছে।
এ দেখে অনেকে মত প্রকাশ করেন যে, হরপ্পায় প্রচলিত ভাষার সাথে দ্রাবিড় ভাষার কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, মুণ্ডা ভাষারও সাদৃশ্য রয়েছে।
এস. আর. রাও নামের একজন ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ৩৬০টি শব্দ থেকে ৩০টি শব্দ বের করে দেখিয়েছেন যে, সিন্ধুর অধিবাসীদের একটা বড় অংশ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
স্কটিশ ইতিহাসবিদ মাইকেল হান্টারের মতে, মিসর, ত্রুটি ও সুমেরীয় হস্তলিপির সঙ্গে সিন্ধু উপত্যকার হস্তলিপির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।
তবে এই লিপিগুলোর অর্থ যথাযথভাবে উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পর্কে সুনিশ্চিত কিছু বলা যায় না। তবে এটা বলা যায়, লিপিগুলো সচিত্র লিখন হিসেবেই প্রথমে প্রকাশ পায় এবং পরবর্তীকালে সেগুলো এক নির্দিষ্টরূপ পরিগ্রহ করে।
লিপিগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডান থেকে বামে ও বাম থেকে ডানে লেখা হতো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার লিপিগুলো আক্ষরিক স্তর থেকে বর্ণমালায় রূপলাভ করে।
সামাজিক শ্রেণি (Social class)
বৈদিক যুগের মতো বর্ণপ্রথা চালু না থাকলেও সিন্ধু সভ্যতায় চার ধরনের শ্রেণি চোখে পড়ে। প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল শাসক, পুরোহিত, চিকিৎসক ও জ্যোতিষী।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল যোদ্ধা। তৃতীয় শ্রেণিতে ব্যবসায়ী, শিল্পী ও কারিগর এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ছিল কৃষক, জেলে, তাঁতি, মিস্ত্রি, গৃহকর্মী ইত্যাদি।
- তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগ | Copper & Bronze Age
- নব্যপ্রস্তর যুগ | Neolithic Age
- প্রত্নতত্ত্বের উৎস | Sources of Archaeology
মর্টিমার হুইলারের মতে, দুর্গের শাসকরা জমি আবাদকারী কৃষকদের ভূমি দাসে পরিণত করেছিল। এছাড়া গৃহদাসদের সমাজের নিচু তলায় অবস্থানরত আরেকটি শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিন্ধু সমাজে ধনী, মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণির যে অস্তিত্ব ছিল তা সেখানকার ছোট, বড় ও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আবাসিক ভবন দেখে অনুমান করা যায়।
পোশাক-পরিচ্ছদ (Dressing)
সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত মূর্তি দেখে নারী ও পুরুষের ব্যবহৃত পোশাক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এখানকার নারী ও পুরুষ উভয়ই সুন্দর ঝলমলে পোশাক এবং অলংকার ব্যবহার করতো।
হাতির দাঁত, সোনা-রূপার অলংকার সেখানে প্রচলিত ছিল। এছাড়া সেখানে কার্পাস ও পশম বস্ত্রের প্রচলন ছিল। মহিলাদের প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহারের কথাও অনুমান করা যায়।
অর্থনৈতিক জীবন (Economic life)
সিন্ধু সভ্যতায় নগর সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলেও জনসংখ্যার অধিকাংশ বাস করতো গ্রামে। কারণ সিন্ধু সভ্যতার অধিকাংশ জনগণ ছিল কৃষিজীবী। এ সভ্যতার অর্থনীতি ছিল কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল।
এ সভ্যতার জনগোষ্ঠী গম, বার্লি, ধান, যব, কার্পাস, খেজুর ইত্যাদি উৎপাদন করত। এ সভ্যতায় অর্থনীতি কিছুটা ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরও নির্ভরশীল ছিল।
সিন্ধু সভ্যতার ব্যবসায়ী শ্রেণি মিসর, মেসোপটেমিয়া, পারস্য, এশিয়ার সমগ্র অঞ্চল, চীন ইত্যাদির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
এ সময়ে ব্যবসা ও ভ্রমণের প্রধান মাধ্যম হিসেবে অগ্রগামী প্রযুক্তি হিসেবে গরুর গাড়ি এবং নৌকা ব্যবহার হতো।
সিন্ধু সভ্যতার লোখালে একটি পোতাশ্রয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে যার দৈর্ঘ্য ৭১০ ফুট ও প্রস্থ ১২০ ফুট। এ সভ্যতা থেকে হাতির দাঁতের তৈরি জিনিস, মণি-মুক্তা, ময়ূর ইত্যাদি রপ্তানি হতো।
অন্যদিকে তামা, রূপা ইত্যাদি আমদানি করা হতো। শিল্পের ক্ষেত্রে তাঁত শিল্পের বিকাশ সিন্ধু সভ্যতায় লক্ষ করা যায়। তামা ও ব্রোঞ্জের সাহায্যে ধাতু শিল্পীরা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, হাতিয়ার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করত। অলংকার তৈরিতেও তারা পারদর্শী ছিল।
লেনদেনের ক্ষেত্রে মুদ্রার প্রচলন তখনও শুরু হয়নি তবে বিনিময় ব্যবস্থা প্রচলিত। ছিল। এ সভ্যতায় ওজন করার নানা সামগ্রী আবিষ্কার হয়েছে। ওজন করার জন্য এ সভ্যতার মানুষ বাটখারা ব্যবহার করত।
তারা দৈর্ঘ্য মাপার জন্য স্কেলের মতো লাঠি ব্যবহার করত। তাদের ওজন পদ্ধতি ছিল ১৬ ভিত্তিক। অর্থাৎ- ৮. ১৬, ৩২, ৬৪ ইত্যাদি।
ধর্মবিশ্বাস (Religious belief)
সিন্ধু সভ্যতা যুগের মানুষদের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে কিছু নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
কারণ এখানে কোনো ধর্ম মন্দির বা উপাসনালয় পাওয়া যায়নি। তবে অনুমান করা হয় সিন্ধুদের মধ্যে মাতৃপূজা খুব জনপ্রিয় ছিল। এছাড়া সিলমোহরে অংকিত চিহ্ন থেকে বুঝা যায় যে, সিন্ধু সমাজে পাশুপতি শিবের পূজা প্রচলিত ছিল।
তারা দেব-দেবী হিসেবে বৃক্ষ, পাথর, সাপ এবং পশুপাখীর উপাসনাও করত। বৃক্ষের মধ্যে পিপল বৃক্ষকে তারা পবিত্র বলে মনে করত। তাছাড়া পাথর, নদী, পশু, গাছ ও লিঙ্গ পূজার নজিরও সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া যায়।
রাজনৈতিক জীবন (Political life)
সিন্ধু সভ্যতার রাজনৈতিক জীবন ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও উন্নত নগর পরিকল্পনা, পৌর জীবন, ওজন পদ্ধতি ইত্যাদি থেকে একটি কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
সিন্ধু সভ্যতায় আবিষ্কৃত সিলমোহর ও বাটখারা পর্যবেক্ষণ করে ধারণা করা হয় যে, সে সময়ের প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ফসলের মাধ্যমে খাজনা আদায় করা।
আর খাজনা আদায়ের জন্য শাসকগোষ্ঠী একটি সুশৃঙ্খল রাজস্বব্যবস্থা ও প্রশাসন গড়ে তুলেছিল। সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম নগর কালিবঙ্গানে দুর্গের অস্তিত্ব ছিল।
এবং প্রতিটি নগরে প্রতিরক্ষার আয়োজন হিসেবে সারিবদ্ধ দুর্গও বিদ্যমান। সিন্ধু সভ্যতার দুর্গগুলোর অস্তিত্ব থেকে অনুমান করা যায় যে, সিন্ধু সমাজের লোকজন নিরবচি শান্তিতে বসবাস করত না।
ঐতিহাসিকদের মতে, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পুরোহিত রাজাই ছিলেন সিন্ধুসভ্যতার প্রশাসনের শীর্ষে।
ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্টুয়ার্ট পিগট এর মতে, সিন্ধু উপত্যকা মহেঞ্জোদারো ও হরয়া রাজধানীর অধীনে শাসিত হতো। এ অনুমানের পিছনে তার যুক্তি হচ্ছে, দুটি নগরী সব দিক থেকেই একই ধাচের ছিল।
শিল্পকলা (Arts)
সিন্ধু সভ্যতায় ষাঁড়, মহিষ, শুকর, হাতি, বাঘ, ভেড়া, গণ্ডার, ঘড়িয়াল, কুমির, হরিণ ইত্যাদির ছবিযুক্ত সিলমোহর পাওয়া গেছে।
তাছাড়া সুরম্য ও কারুকার্যখচিত অট্টালিকা, সুন্দর ডিজাইনের মৃৎপাত্র, হাতির দাঁতের দ্রব্যসামগ্রী, স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা ও ঝিনুকের অলংকার ইত্যাদি পাওয়া থেকে প্রমাণিত হয় যে, সিন্ধু সভ্যতা শিল্পকলায় এবং কারুকার্যে বেশ সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এ সময়ে গৃহস্থালির ব্যবহারের জন্য সাধারণত মাটির দ্রব্যই প্রচলিত ছিল।
অসংখ্য মাটির পাত্র, পোড়ামাটির খেলনা, কুমোরের চাক, ছোট ছোট চেয়ার এমনকি পাশা খেলার গুটিও পাওয়া গেছে। স্ট্যাম্প সিল ছিল মহেজোদারো- হরপ্পা শহর দুটির অঙ্কন ও চিত্র শিল্পের প্রধান মাধ্যম এবং সবচেয়ে সাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার।
মহেঞ্জোদারোতেই ২৫০০ সিল মোহর পাওয়া গেছে যার অধিকাংশই পশুর ছবি সম্বলিত। ১ সিন্ধু সভ্যতার শিল্পীরা বড় আকারের ভাস্কর্য নির্মাণে আগ্রহী ছিল না।
হরপ্পায় প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের কয়েকটি পশুমূর্তি (মহিষ, হাতি, গণ্ডার ইত্যাদি মূর্তি) এ সভ্যতার ভাস্কর্যে উৎকর্ষের প্রমাণ।
ব্যবহারিক প্রযুক্তি (Technology)
তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে সূচ, কাঁচি, চাকু, আয়না, চিরুনি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। সিন্ধু যুগে লৌহের ব্যবহারের প্রচলন ছিল না।
তখনকার মানুষ যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ব্রোঞ্জ নির্মিত কুঠার, ছুরি, তীর, ধনুক, শিঙ্গা, তরবারি, ঢাল, বর্শা ইত্যাদি হাতিয়ার ব্যবহার করতো।
- তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগ | Copper & Bronze Age
- নব্যপ্রস্তর যুগ | Neolithic Age
- প্রত্নতত্ত্বের উৎস | Sources of Archaeology
সিন্ধু সভ্যতার প্রসার ও প্রভাব (Expansion and impact of indus valley)
সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন আর্য সভ্যতার পূর্বেও যে ভারতীয় উপমহাদেশে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল তার প্রমাণ মেলে।
তবে ব্রোঞ্জযুগের সভ্যতা হওয়ায় এর খুব বেশি বিকাশ ঘটেনি। সিন্ধু সভ্যতা কেবল মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা সিন্ধুর অন্যান্য অঞ্চল যেমন হায়দ্রাবাদ থেকে জ্যাকিবাদ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
এছাড়া পশ্চিম ভারতসহ বেলুচিস্তানের উত্তর ও পশ্চিম এলাকা জুড়ে এ সভ্যতার প্রসার এবং প্রভাব ঘটেছিল।
উত্তর প্রদেশ, বিহার, পাটনা ইত্যাদি অঞ্চলে প্রাপ্ত পুঁতির মালা ও চিত্র পদ্ধতির ধ্বংসাবশেষ থেকে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার প্রভাব ছিল। ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ তথা দ্রাবিড়দের সামাজিক প্রথা ও ধ্যান-ধারণা আর্যরা অনুকরণ করেছিল।
এমনকি হিন্দু ধর্মের মৌলিক ধারণার কিছু অংশ সিন্ধু সভ্যতা থেকে গৃহীত বলে অনুমান করা হয়। ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে এ সভ্যতার প্রভাব অনস্বীকার্য।
সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তি (Fall of the Indus Valley Civilization)
বলা হয়, সভ্যতা গড়তে অনেক সময় লাগলেও পতনে অধিক সময় লাগে না। সিন্ধু সভ্যতার পতনের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো অস্পষ্ট। এ সময়ের কোনো দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া যায় না।
কানাডিয়ান ইতিহাসবিদ টেইলর (Alartair M. Tylor) ও মার্কিন ইতিহাসবেত্তা ওয়ালব্যাংক (T. Walter Wallbank) তাদের 'Civilization Past and Present' গ্রন্থে বলেন, “সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর প্রায় পাঁচশত বছরের ভারতীয় ইতিহাস আমাদের অজানা।"
এজন্য ইতিহাসবিদরা কেবল অনুমান করতে পারেন। হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্টেইনের (Aurel Stein) মতে, “তাম্র যুগ থেকেই সিন্ধু উপত্যকার জমি সাদা ও শুষ্ক হয়ে উঠেছিল।”
একে অনেকেই সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ বলে মনে করেন। ভারতীয় ইতিহাসবিদ ড. অতুল সুর এ সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হিসেবে চিন্তাশক্তির বন্ধ্যাত্বকে দায়ী করেছেন।
তার মতে, সময় বা কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজন হয় চিন্তাশক্তির সংস্কারের। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি বা নতুন নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে কোনো মনোযোগ ছিল না।
ফলে সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতা (মিশরীয়, মেসোপটেমীয় ইত্যাদি) থেকে তারা সবক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে, যার অনিবার্য পরিণতি ছিল ধ্বংস।
প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের জন্য একাধিক কারণ দায়ী। বিভিন্ন পণ্ডিতেরা সিন্ধু সভ্যতা পতনের কতকগুলো সম্ভাব্য কারণের উল্লেখ করেছেন। যেমন:
- ক. মহামারি, বন্যা, প্লাবন ও ভূমিকম্প (প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫০ অব্দে সংঘটিত।
- খ. প্রলয়ংকরী বন্যায় সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছে)। বহিঃশত্রুর আক্রমণ (আর্যদের আক্রমণ)
- গ. অভ্যন্তরীণ সংকট
- ঘ. মাটির উর্বরতা হ্রাস ও অবক্ষণ
- ঙ. আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন
- চ. গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া, বন উজাড় ও মরুকরণ
- ছ. ভৌগোলিক আকার আকৃতির পরিবর্তন
মর্টিমার হুইলারের মতে, “সিন্ধু সভ্যতার অর্থনৈতিক অবক্ষয় ছিল স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত হয়, নাগরিক জীবন ও জীবনবোধ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় এবং নগরগুলো ধ্বংসের মুখে পড়ে।”
উল্লেখ্য যে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ছিল অনিশ্চিত বাস্তুসংস্থানের ওপর নির্ভরশীল, যা সহজেই নিশ্চিহ্ন হতে পারে।
এই সিন্ধু সভ্যতার এই অবক্ষয়ে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার সভ্যতার প্রাথমিক যুগের পতন ঘটে। পরবর্তীকালে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটে।
0 Comments