প্রত্নতত্ত্ব হলো পুনরুদ্ধার ও বস্তুগত সংস্কৃতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের কর্মকাণ্ডের অধ্যয়ন। এর প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো মানব ইতিহাস খুঁজে বের করা। আর এ কাজ করতে গিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিককে বিভিন্ন উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। এগুলো হলো:
প্রাচীন সাহিত্য (Ancient Literature)
প্রাচীন শিল্প সাহিত্য মানব বসতির অবস্থান নির্ণয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় জাতীয় ও স্থানীয় ইতিহাস গ্রন্থও উত্তম উৎস হিসেবে কাজ করে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হোমারের মহাকাব্য “ইলিয়াড' পাঠের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন ট্রয় নগরীর অবস্থান খুঁজে পেয়েছেন।
মৌখিক ইতিহাস (Oral History)
অনেক সময় সমাজের বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকে শোনা স্থানীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ক তথ্যাদি প্রত্নতত্ত্বের উৎস হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিকরা পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন প্রদেশে বসবাসকারী কালাস সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত গল্প-গাথার মাধ্যমে এ অঞ্চলে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির সাথে মেসিডোনিয়ান গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের যোগসূত্র জানতে পারেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক যন্ত্রপাতি (Artifacts)
দেশের জাতীয় ও স্থানীয় জাদুঘরে রক্ষিত কিংবা ব্যক্তিগতভাবে সংগৃহীত বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং যন্ত্রপাতি প্রত্নতাত্ত্বিকের কাছে অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্থানীয় জ্ঞান (Indigenous knowledge)
কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের ধারণা বা জ্ঞান প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন- বগুড়ার মহাস্থানগড় সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা সেখানে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্লেষণে সহায়তা করেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসিদ্ধান্ত (Archaeological Hypothesis)
প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোনো স্থানে খনন কাজ শুরু করার পূর্বে অনুসিদ্ধান্ত বা পূর্বানুমান গ্রহণ করেন, যা প্রত্নতত্ত্বে ইতিহাস বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে।
সরকারি উৎস (Public source)
বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন- জাদুঘর, গ্রন্থাগার, জাতীয় আর্কাইভস, জাতীয় স্থাপনা ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস হিসেবে বিবেচিত
পূর্ব জরিপ (Previous Survey)
ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে প্রকাশিত স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, স্যুভেনির, জার্নাল, গ্রন্থ ইত্যাদি প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে।
সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের তথ্য (Information of Cultural Anthropology)
সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীয় উদঘাটিত তথ্য প্রত্নতত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত। যেমন- সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে মানুষের শরীরের গঠন সম্পর্কে মতামত দেন, যা প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণায়ও সহায়ক হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমেরিকান সামাজিক নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান ইরোকোয়া ইন্ডিয়ানদের শারীরিক গঠন, প্রথা, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে তার Ancient Society' গ্রন্থে যে মতামত দিয়েছেন তা এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্লেষণে সাহায্য করেছে।
প্রত্নতত্ত্বের সময়কালের ভিত্তিতে সমাজের শ্রেণিবিভাগ | Classification of Society on the basis of Archaeological Period
লিখন শক্তির ওপর ভিত্তি করে মানব সমাজের ইতিহাসকে দু'ভাগে আলোচনা করা হয়। যথা- পাথরের যুগ ও ধাতুর যুগ। লিখন-পূর্ব মানব সমাজ ছিল পাথরের যুগের অন্তর্ভুক্ত।
আর লিখতে শেখার পর মানব সমাজ ধাতুর যুগের সাথে সম্পর্কিত। অন্যদিকে মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ারের ভিত্তিতে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মানব ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: পুরোনো প্রস্তর, নতুন প্রস্তর ও ধাতু যুগ।
ধাতু যুগকে কেউ কেউ আবার দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- ব্রোঞ্জ যুগ ও লৌহ যুগ। প্রত্নতাত্ত্বিক যুগ বিভাগের ভিত্তি যদিও হাতিয়ার তৈরির উপকরণ ও কৌশল, তবে এই যুগ বিভাগের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক উপাদানের গুরুত্বও কম নয়।
কারণ হাতিয়ার তৈরির উপকরণ ও কৌশল পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবিকার উপায় এবং উপকরণে পরিবর্তন ঘটেছে। আর উৎপাদনের কৌশল পরিবর্তিত হওয়ায় মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বদলে গেছে।
পাশাপাশি উৎপাদনের কৌশল ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের ফলে সমাজের সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনে পরিবর্তন এসেছে।
সুতরাং বলা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিক যুগবিভাগ মূলত এক একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যুগকে নির্দেশ করে নিম্নলিখিতভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক সময়কালের ভিত্তিতে সমাজের শ্রেণিবিভাজন করা যায়—
- প্রস্তর যুগ (Paleolithic age)
- প্রাচীন প্রস্তর যুগ (Early or lower paleolithic age)
- মধ্য প্রস্তর যুগ (Middle paleolithic age)
- নব্যপ্রস্তর যুগ (Neolithic age)
- তাম্র যুগ (Copper age)
- ব্রোঞ্জ যুগ (Bronze age)
- লৌহ যুগ (Iron age)
নিচের সারণিতে যুগের ভিত্তিতে সমাজের শ্রেণী বিভাজন তুলে ধরা হলো :
ক্রমিক নং | ভূতাত্তিক যুগ | প্রত্নতাত্ত্বিক যুগ | বছর আগে | মানব প্রজাতি |
১ | হেলোসিন | ধাতু যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ | ৩০০০
৫০০০ ১৩০০০ |
আধুনিক মানুষের বিভিন্ন ধারা |
২ | উচ্চ প্লাইসটোসিন | উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর যুগ, মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ |
৪০০০ | ক্রোম্যাগনন মানব |
৩ | মধ্যপ্লাইসটোসিন | নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগ | ৮০০০০০ | পিকিং মানব |
আবার আদিম মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ারের ক্রমবিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের দক্ষতা নির্ণয়ের মাধ্যমে প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রস্তর যুগকে চার ধাপে বিভক্ত করেন। যথা:
- ঊষা প্রস্তর যুগ (Eolithic Age)
- প্রাচীন প্রস্তর যুগ (Paleolithic Age)
- মধ্য প্রস্তর যুগ (Mesolithic Age)
- নব্যপ্রস্তর যুগ (Neolithic Age )
যুগের এসব বিভক্তির পরও বলা যায়, ইতিহাসের কোনো শ্রেণিবিভাগই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।
কারণ ইতিহাস কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমষ্টি নয় বরং অসংখ্য ঘটনার অনুক্রম। বর্তমানের মধ্যে যেমন অতীতের রেশ থাকে, তেমনি থাকে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।
0 Comments